কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি ঃ অগ্রহয়ণের ভোরে হিমে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় কিছুটা শীতের আমেজ। ভোরে ঘন কুয়াশায় খানিক দূরের দৃশ্য ঝাপসা। এর মধ্যেই সকালে কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে দল বেঁধে ছুটছে মানুষেরা। সবার গন্তব্য নবান্নের মাছের মেলায়। সারি সারি পিকআপ, ভটভটি ও ট্রাকে বিশাল বিশাল সাইজের জ্যান্ত সব মাছ এনে নামানো হচ্ছে মেলায়। পিকআপ, ভটভটি ও ট্রাকের চাকার চাপ আর পানি পড়ে সড়কে কাঁদামাটি হয়েছে। দূর থেকে ভেসে আসছে মানুষের গমগম কণ্ঠ। মেলায় ভিড় ঠেলে এগোতেই কানে পড়ল মাছ বিক্রেতাদের হাঁকডাক। তারা ক্রেতাদের উদ্দেশে বলছে-‘মাছ…ভাই…,বড় বড় মাছ..। পুকুর, দিঘী ও নদীর মাছ। বাঁচা মাছ, খুব স্বাদের মাছ, দেখে যান, নিয়ে যান, এ মাছ ফুরাইলে আর পাবেনা ভাই…। সেখানে ৩ থেকে ১৫ কেজির কাতলা, রুই,মৃগেল, জি-থ্রি রুই, বিগহেড, পাঙ্গাস, সিলভার, ব্ল্যাককার্প মাছ। সেখানে সুন্দর করে সাজানো কাতলা, রুই, মৃগেল, জি-থ্রি রুই, ব্ল্যাককার্প, পাঙ্গাস, গ্রাসকার্প, কার্ফু, কালবাউশ, বিগহেড, সিলভার কার্পসহ হরেক রকমের মাছ। সেখানে ভোর থেকে বছেসে সারি সারি মাছের দোকান। চলছে হাঁকডাক ও দরদাম। মাছের আকার অনুযায়ী প্রতি কেজি মাছ ২শ থেকে ১২শ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারাও ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে কিনছেন ঐসব মাছ। আবার দেখতে এসেছেন অনেকেই।
জানাগেছে,নবান্ন উৎসব উপলে ঐতিহ্যবাহী কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে এই মাছের মেলা প্রতিবছর বসে পয়লা অগ্রহায়ণে। তবে তারিখটি সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি মেনে নয়, পুরোনো বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা পুরোনো বাংলা বর্ষপঞ্জি ধরেই তাদের পূজা-উৎসব-পার্বণের দিনণ ঠিক করে। ওই পঞ্জিকা অনুসারে আজ শনিবার পয়লা অগ্রহায়ণ। দিনটি হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব হিসেবে পালন করে আসছে ঐতিহ্যবাহী কাল ধরে। প্রতিবছর এই উৎসব ঘিরে কালাই-মোকামতলা মহাসড়কের পাশে কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে একদিনের মাছের মেলা বসে। এ মেলাকে কেদ্র করে কালাই পৌরসভাসহ উপজেলার মাত্রাই, উদয়পুর, জিন্দারপুর, পুনট ও আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের প্রায় ৬০টি গ্রাম-মহল্লা থেকে লোকজন মেলায় ছুটে আসেন। এমকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে শত..শত মানুষ এই মাছের মেলা দেখতে আসেন। এলাকার প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে ঘরে ঘরে নতুন চালের ীর, পিঠা, পুলি,পায়েস আর ফিরনি দিয়ে মেহমানদের আপ্যায়ন করতে ধুম পড়ে যায়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানের চালে নবান্ন উৎসব করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কালাই পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের পাঁচশিরা বাজারে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে একদিনের জন্য বসেছে মাছের মেলা। তবে এই মাছের মেলায় শুধুই মাছ কেনার বিষয় নয়, আছে একধরনের জামাই-মেয়েদের কেনার প্রতিযোগিতা। কোন জামাই কত বড় মাছ কিনলেন, সেটাই আসল বিষয়। প্রতিযোগিতায় নীরব অংশগ্রহণ করে শ্বশুরেরা। এ দিনটিকে ঘিরে এখানে দিনব্যাপী চলে মাছ কেনা ও বিক্রি করার উৎসব। কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে মাছ নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। মেলায় উঠেছে বড় বড় সব মাছ। অর্ধশতাধিক দোকানে এসব মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন। দূর-দূরান্তর থেকে দলে দলে লোকজন মেলায় এসেছেন মাছ কিনতে। ক্রেতারা মাছের দাম হাকাচ্ছেন, কিনছেন, আবার কেউ কেউ সেলফি তুলতেও ব্যস্থ । শুধু সেলফি তুলেই শেষ নয়। মাছ মেলার ছবি দিয়ে কেউ কেউ আবার ঝড় তুলছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। এই মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসেছিল এই মেলায়। ক্রেতারা খালিহাতে ফিরছেন না কেউ। সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ কিনে খুশিমনে বাড়ি ফিরছেন। মেলা উপলে ওই যেন এলাকায় ঈদের আনন্দ বিরাজ করছিল। আর এই দিনটির জন্য পুরো বছর অপোয় থাকেন কালাই উপজেলাবাসি।
মেলার পাশের বেগুন গ্রামে থেকে মেলায় এসেছেন রোজিনা বেগম। তিনি বলেন, স্বামীকে নিয়ে মাছের মেলায় ঘুরতে এসেছেন। মেলাটির নাম আগেই থেকে জানি, কিন্তু আসা হয়না। মেলায় এসে বড় বড় মাছ দেখছি। অনেক আনন্দ লাগছে। ঘুরেফিরে মেলা থেকে স্বাদ ও সাধ্যের কথা মাথায় রেখে পছন্দের মাছটি কিনবেন বলে জানান তিনি।
মেলায় মাছ কিনতে আসা জিয়াদুল নামে এক জালাই বলেন, অন্য বছরের চাইতে এবার মাছের দাম অনেক বেশী। তবে যাই হউক না কেন এই মেলা থেকে ১৫ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ কিনে নিয়ে শশুর বাড়ি যাচ্ছি।
সেখানে মাছ দেখতে আসা কালাই পৌসভার কামারপাড়া মহল্লার বিনয় রায় বলেন, হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব হিসেবে প্রায় অর্ধশত ঐতিহ্যবাহী মেলাটি যেমন মাছের জন্য বিখ্যাত, তেমনি এই এলাকায় ধান-আলুতেও ভরপুর থাকে। এ কারণে আশপাশের লোকজন মেলায় ছুটে আসে।
এই মেলায় মাছ বিক্রেতা আব্দুল লতিফ বলেন, মেলায় ছোট-বড় মিলে অর্ধশতাধিক মাছের দোকান বসেছে। এই মাছের মেলাতে বড় পুকুর, দিঘি ও নদী থেকে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, মৃগেল, বিগহেড, পাঙ্গাস, সিলভার, ব্ল্যাককার্প মাছ বিক্রি হচ্ছে। রুই ও কাতলা মাছ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে। মৃগেল, ব্ল্যাককার্প মাছ ওজনভেদে ৫৫০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও ১৫ কেজি ওজনের জি-থ্রি রুই মাছ ১৩০০ টাকা কেজি দরে দাম চাওয়া হচ্ছে। অন্য বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা কম। তাই মাছও বিক্রি হচ্ছে মোটামুটি। দামও আছে স্বাভাবিক।
সেখানে আরেক জন মাছ বিক্রেতা রনি বলেন, আমি প্রতিবছরই এ মেলায় মাছ বিক্রি জন্য আসি। বর্তমান সবজিনিসের দাম বৃদ্ধি,তবে মাছের বাজারে তুলনায় মাছের দাম বেশি হলেও সবাই আনন্দের সঙ্গে মাছ কিনছেন। এবার মাছ নিয়ে বিপাকে পড়তে হবেনা। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্তত ৬ থেকে ৮ মণ করে মাছ বিক্রি করেন। তাছাড়া লাভও মোটামুটি হবে।
কালাই পৌর পাঁচশিরা বাজার ইজারাদার গোলাম আজম বলেন, প্রতিবছর এই দিনে মাছের মেলা বসে। এই মাছের মেলায় শতাধিক দোকান মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তবে মাছ ব্যবসায়ীরা মেলার আগে এক সপ্তাহ ধরে এলাকায় মাইকে প্রচার করেন। এই দিনে মেলায় প্রচুর মাছ আমদানি এবং বিক্রি হয়।
মেলা সম্পর্কে কালাই পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৌফিকুল ইসলাম তৌফিক বলেন, এই মাছের মেলাটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা যতই হোক না কেন, এ মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে বহন করছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
কালাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ার আলী বলেন, এ মেলার প্রধান আকর্ষণ বড় বড় মাছ। স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ী ও মাছ চাষিরা বিভিন্ন এলাকা থেকে সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে এবং মেলায় বিক্রি করেন। এই মেলায় কেউ যেনো বিষাযুক্ত মাছ বিক্রি করতে না পারে সেদিকে আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাত আরা তিথি বলেন, নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই কালাই পাঁচশিরা বাজারে মাছের মেলা বসে। এই মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে এখানে উৎসব মুখর পরিবেশ তৈরি হয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হওয়ায় নবান্নের এই মেলায় মাছ কেনাকাটা করতে আসেন সব সম্প্রদায়ের মানুষেরা।