ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন সোয়া ১২টা। দিনভর যানজটের পর ক্লান্ত সড়ক তখন ফাঁকা। কিন্তু মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যাান্ডে বিআরটিসি ডিপোর সামনের সড়কে একটি ট্রাক ঘিরে শতাধিক মানুষের জটলা। জীর্ণ মলিন পোশাক তাদের দারিদ্রের বয়ান দিচ্ছে। ছুটির আগের রাতে ভদ্রপল্লীর বাসিন্দারা যখন ঘুমের প্রস্তুতিতে, তখন এত মানুষ কেন ট্রাকের পেছনে ভিড় করছেন? তল্লাশ করতে উঁকি দিয়ে জানা গেল, তারা কম দামে টিসিবির তেল, চিনি, ডাল কিনতে দিনভর হাড় খাটুনির পর ঘুম ফেলে ভিড় করেছেন ট্রাকের জন্য।
সালেহা বেগমের বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। থাকেন মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে। কী করেন, জানতে চাইলে উত্তর দিলেন, ‘শরমের কথা কী কমু? বাসাবাড়িতে কাম করি’। স্বামী অসুস্থা। সালেহার আয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আসছে রমজান। রোজা তো রাখতে হবে। কিন্তু ছোলা, খেজুর, চিনি, তেলের যা দাম, তাতে পাগল দশা! তাই টিসিবির সস্তার মালই ভরসা। সারাদিন ট্রাকের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ট্রাক আসেনি। দিন গড়িয়ে যখন এল, তখন সন্ধ্যাে ৭টা। পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ৮৯০ টাকায় দুই লিটার তেল, পাঁচ কেজি পেঁয়াজ, দুই কেজি করে চিনি, ডাল, ছোলা, খেজুর কিনেছেন। বাজারে কিনতে ১৪০০ টাকা লাগত। ৫১০ টাকা সাশ্রয়ের জন্য এতটা সময় লাইলে দাঁড়িয়ে কাটান সালেহা।
তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনও শতাধিক মানুষের লাইন ছিল ট্রাকের পেছনে। এমএস ট্রেডার্স এই ট্রাকের ডিলার। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জনৈক বাবু। ট্রাক থেকে মালামাল মেপে বিক্রির দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা তার পুরো নাম বলতে পারলেন না।
বিক্রেতা সিদ্দিকুরের কাছে জানতে চাই মধ্যরাতে কেন পণ্য বিক্রি করছেন। তিনি জানালেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় মালামাল পেয়েছেন। সন্ধ্যা ৭টায় মোহাম্মদপুরে গাড়ি নিয়ে এসেছেন। সিদ্দিকুরের ভাষ্য, আগে যখন চাপ কম ছিল, তখন বেলা ১১-১২টার মধ্যে মাল পেতেন, দুপুরে এসে বিকেলের মধ্যে বিক্রি শেষ করতেন। এখন খুব চাপ। গাড়িও অনেক বেড়েছে। মাল পেতেই সন্ধ্যা হচ্ছে।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে গাড়ির পেছনে যে ভিড় ও গাড়িতে যে পরিমাণ মালামাল ছিল, তাতে অনুামান রাত ৩টার আগে বিক্রি শেষ হবে না। ততক্ষণ খোলা রাস্তায় অপেক্ষায় থাকতে হবে দ্রব্যমূল্যে পাগলা ঘোড়ায় পিষ্ট নিম্নবিত্তের ক্রেতাদের। নিত্যেপণ্যে বাড়তি দামে সংসার চালানো কঠিন দায় হয়ে পড়ায়, এছাড়া আর উপায়ও নেই সীমিত আয়ের মানুষদের। আগের আয়ে বাড়তি ব্যয়ের সঙ্গে সামাল দিয়ে চলতে রাতের ঘুম হারাম করে ট্রাকের পেছনে ছোটা ছাড়া উপায় আর কী?