আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় নতুন আরো কয়েকজন সদস্যের নাম ঘোষণা করেছে তালেবান। মঙ্গলবার কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন অন্তর্বর্তীকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি উপমন্ত্রী ও তালেবানের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ।
তবে এবারো কোনো নারীকে মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে যুক্ত করা হয়নি।
মুজাহিদ বলেন, জনগণকে সেবা দেয়ার বিষয়ে মূল লক্ষ্য রাখতেই নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আশা প্রকাশ করেন, নিকট ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের মন্ত্রিসভাকে স্বীকৃতি দেবে।
মুজাহিদ আরো বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক চাহিদা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব দিয়েই মেটানো যেতে পারে।
তবে বিদেশে থাকা আফগানিস্তানের সব সম্পদ ছাড়িয়ে আনার জন্য সব ধরনের কূটনীতিক চ্যানেল তারা কাজে লাগাচ্ছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান জবিউল্লাহ মুজাহিদ।
সংবাদ সম্মেলনে মেয়েদের শিক্ষা ও নারীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারীদের কাজ ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করছে।
তিনি বলেন, ‘মেয়েরা যাতে তাদের শিক্ষা চালু রাখতে পারে তার প্রক্রিয়া সম্পন্নে আমরা কাজ করছি।’
নতুন যুক্ত হওয়া মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্যমন্ত্রী হাজী নুরুদ্দিন আজিজি, বাণিজ্য উপমন্ত্রী হাজী মোহাম্মদ বশির ও হাজি মোহাম্মদ আজিম সুলতানজাদা, গণস্বাস্থ্যমন্ত্রী কালান্দার ইবাদ, গণস্বাস্থ্য উপমন্ত্রী আবদুল বারি ওমর ও মোহাম্মদ হাসান গিয়াসি, স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ ইবরাহিম, প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী মোল্লা আবদুল কাইয়ুম জাকির উল্লেখযোগ্য।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার জেরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হামলার জন্য আফগানিস্তানে আশ্রয়ে থাকা আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করেন। ওই সময় আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানান বুশ।
তালেবান সরকার ওসামা বিন লাদেনকে তুলে দেয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে মার্কিনিদের কাছে প্রমাণ চায়। প্রমাণ ছাড়া তারা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
বুশ প্রশাসন ও তালেবানের মধ্যে বিরোধের জেরে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে মার্কিন বাহিনী। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জ্বিত মার্কিন সৈন্যদের হামলায় তালেবান সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তবে একটানা দুই দশক যুদ্ধ চলতে থাকে দেশটিতে।
এরইমধ্যে আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সদস্য দেশগুলোও যুক্ত হয়। মার্কিনিদের সমর্থনে নতুন প্রশাসন ও সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠে দেশটিতে।
২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সৈন্যদের এক ঝটিকা অভিযানে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। ২০১৩ সালে অজ্ঞাতবাসে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরেরও মৃত্যু হয়।
তা স্বত্ত্বেও তালেবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে।
দীর্ঘ দুই দশক আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বের বহুজাতিক বাহিনীর দখলের পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করতে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশ নিতে তালেবান সম্মত হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুসারে ৩১ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে বহুজাতিক বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের ডেডলাইন থাকলেও ৩০ আগস্ট সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়।
মার্কিনিদের সাথে চুক্তি অনুসারে ক্ষমতাসীন থাকা মার্কিন সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকারের সমঝোতার জন্য তালেবান চেষ্টা করলেও দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। তালেবানের অভিযোগ, আশরাফ গনির নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসে বহুজাতিক বাহিনীর প্রত্যাহারের মধ্যেই পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো শুরু করে তালেবান।
৬ আগস্ট প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলীয় নিমরোজ প্রদেশের রাজধানী যারানজ দখল করে তারা। যারানজ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ১০ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুলে পৌঁছে যায় তালেবান যোদ্ধারা। তালেবানের অগ্রসরে আশরাফ গনির কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জেরে আফগান প্রশাসন ভেঙে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ আগস্ট কাবুলে প্রবেশ করে তালেবান যোদ্ধারা।
তবে কাবুলের উত্তরের দুর্গম পাঞ্জশির প্রদেশ শুধু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গিয়েছিলো। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদের নেতৃত্বে তালেবানবিরোধী বিদ্রোহী যোদ্ধারা এই উপত্যকায় অবস্থান নিয়েছিলো।
৬ সেপ্টেম্বর পাঞ্জশির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তালেবান। এর পর ৭ সেপ্টেম্বর দলীয় প্রধান মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকে রাষ্ট্রপ্রধান ও রাহবারি শুরার সদস্য মোল্লা হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন আফগান সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় দলটি।