রাত পোহালেই আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হত্যা প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে প্রার্থী পরিবর্তনসহ একাধিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে আমেরিকাবাসী।
‘সমাবেশে ট্রাম্পের ওপর গুলি’
১৯৮১ সালে রোনাল্ড রিগানের পর ডনাল্ড ট্রাম্প প্রথম প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী যাকে লক্ষ্য করে গত ১৩ জুলাই গুলি চালানো হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পেনসিলভানিয়ার বাটলারে যখন সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। গুলিটি তার কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়ায় অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন ট্রাম্প। সিক্রেট সার্ভিস কাউন্টার স্নাইপারের হাতে নিহত হওয়ার আগে ২০ বছর বয়সী থমাস ক্রুকস কাছাকাছি একটি ভবনের ছাদ থেকে আটটি গুলি ছুড়েছিলেন। সাবেক স্বেচ্ছাসেবক ফায়ার চিফ কোরি কমপেরেটোর ভিড়ের মধ্যে গুলিবদ্ধ হন। তিনি সেইসময়ে তার পরিবারকে গুলি থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। ট্রাম্পকে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা যখন উদ্ধার করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সমর্থকদের কাছে ‘লড়াই’ করার জন্য কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এক সমাবেশে বলেছিলেন ‘আমি গণতন্ত্রের জন্য বুলেট হজম করেছি।’
‘মাস্কের সমর্থন ট্রাম্পকে’
ট্রাম্পকে শুটিংয়ের রাতে টেসলার প্রধান বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক এক্স-এ পোস্ট করেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পুরোপুরি সমর্থন করি এবং তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি’। বিষয়টি ট্রাম্পের জন্য বেশ লাভজনক। এক্স মালিকের বিপুল সামাজিক মিডিয়া উপস্থিতি তার ওয়ালেটের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে মাস্ক একটি প্রচারাভিযান গোষ্ঠীকে ৭৫ মিলিয়ন ডলার এবং অক্টোবরের প্রথমার্ধে প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিলেন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট বিডকে সমর্থন করার জন্য। তিনি ট্রাম্পের বেশ কয়েকটি সমাবেশে বক্তৃতাও করেছেন।
‘দৌড় থেকে বাদ বাইডেন’
জো বাইডেন জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট পদের দৌড় থেকে নাম প্রত্যাহার করার আগে তার ওপর বেশ চাপ ছিল। ২৭ জুন প্রথম টিভি বিতর্কে অংশ নেন দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন। কিন্তু সেখানে একেবারেই খেই হারিয়ে ফেলেন ৮১ বছর বয়সী বাইডেন। তোতলামি, অস্পষ্ট কথাবার্তা, কথার মাঝখানে কী বলছেন তা ভুলে যাওয়া—কার্যত এই বিতর্ক ‘সার্কাসেই’ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে বাইডেনের নামটি চলে যায় বাতিলের খাতায়। এরপরেই বাইডেনের জায়গাটি নেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস। হ্যারিসকে সমর্থন দেওয়ার এবং ডেমোক্র্যাটদের তার প্রচারে অনুদান দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান বাইডেন।
‘হ্যারিসের দৌড়’
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন পেলেও কমালা হ্যারিসকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমোক্র্যাটদের নতুন প্রেসিডেন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বেছে নেওয়া দরকার ছিল। বাইডেন বাদ পড়ার পরেই ৬০ বছর বয়সী হ্যারিসের কয়েকজন সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে সমর্থন করার পরে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আর কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেনি। শেষ পর্যন্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আনুষ্ঠানিকভাবে সময়সীমার আগে নিজেদের উপস্থাপন করেনি যার জেরে হ্যারিসকে আগস্টের শুরুতে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। মনোনয়ন গ্রহণের পর তার প্রথম বক্তৃতায় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে হ্যারিস বলেছিলেন, তার একটি নতুন পথ তৈরি করার সুযোগ উপস্থিত।
‘কমালা আইএস ব্র্যাট’
হ্যারিসের মনোনীত প্রার্থী হওয়ার জন্য তার দলের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল, তবে তার পক্ষে সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাটিক ভোটারদের সমর্থন জোগাড়ও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্রান্ডিংয়ের দরকার ছিল। যে কাজটি সহজ করে দেন বৃটিশ পপ তারকা চার্লি। এক্সসিএক্স তাকে সমর্থন করে এক্স-এর একটি পোস্টে চার্লি লেখেন,’কমালা আইএস ব্র্যাট’। নামটা উদ্ভট শোনালেও এক্সসিএক্স ছিল গ্রীষ্মে প্রকাশিত চার্লির একটি হিট অ্যালবাম। তাই চার্লির সমর্থন কমালাকে বিশেষ সুবিধা এনে দেয়।
‘সন্তানহীন বিড়াল’
২০২১ সালে ট্রাম্পের রানিং মেট জেডি ভ্যান্সের করা মন্তব্যগুলিও শিরোনামে এসেছে। সেই সময়ে ফক্স নিউজের সাথে কথা বলার সময় ভ্যান্স বলেছিলেন,’ মিসেস হ্যারিস এবং অন্যান্য ডেমোক্র্যাটরা অনেকটা সেইসমস্ত বিড়ালদের মতো যারা নিঃসন্তান। তারা নিজেরাই নিজেদের জীবনকে দুঃখী করে তুলেছেন। ‘ডেমোক্র্যাটদের পুরো ভবিষ্যত সন্তানহীন লোকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলেও উল্লেখ করেন ভ্যান্স। ফ্রেন্ড স্টার জেনিফার অ্যানিস্টন ভ্যান্সের মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে ইনস্টাগ্রামে লেখেন, ’আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সম্ভাব্য ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এরকম মন্তব্য আসছে।’ হ্যারিস তার প্রচারাভিযানে ভ্যান্সের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতিটি আমেরিকানই এই দেশের ভবিষ্যতের অংশীদার।’
’হ্যারিসের জাতিগত পরিচয় নিয়ে ট্রাম্পের প্রশ্ন’
শিকাগোতে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্ল্যাক জার্নালিস্ট দ্বারা আয়োজিত একটি কনভেনশনে শ্রোতাদের সামনে ট্রাম্প হ্যারিসের জাতিগত পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘তিনি কি ভারতীয় নাকি তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ?’ ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি তাকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি, পরোক্ষভাবে প্রত্যক্ষভাবে নয়… এবং তিনি সর্বদা ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রচার করে এসেছেন। আমি জানতাম না কয়েক বছর আগে তিনি কিভাবে কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে গেলেন এবং এখন তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচিত হতে চান। তাই আমি জানি না, তিনি কি ভারতীয় নাকি কৃষ্ণাঙ্গ ? কমালা হ্যারিসের বাবা একজন জ্যামাইকান এবং মা একজন ভারতীয়। উভয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী। জবাবে, হ্যারিস বলেছিলেন এই মন্তব্যগুলি অনেক পুরোনো হয়ে গেছে।
‘ইনি আমার বাবা!’
মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজ তুলনামূলকভাবে অপরিচিত ছিলেন যতক্ষণ না হ্যারিস তাকে তার ভাইস প্রেসিডেন্টের রানিং মেট হিসাবে আগস্টের শুরুতে বেছে নিয়েছিলেন।কিন্তু তিনি সত্যিই কয়েক সপ্তাহ পরে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে একটি যুগান্তকারী বক্তৃতা দিয়ে বিশেষ ছাপ ফেলতে সক্ষম হন। তিনি তার দলের বিশ্বস্তদের বলেছিলেন যে ডনাল্ড ট্রাম্পের অধ্যায় শেষ। পাতা উল্টানোর সময় উপস্থিত। আপাতদৃষ্টিতে ওয়ালজ তার ছেলে গাসের কাছ থেকে সবথেকে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন , যখন বক্তৃতার মাঝপথে দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল হয়ে গর্বিতভাবে গাস বলেছিলেন, ‘ইনি আমার বাবা!’
‘টেলর সুইফটের হ্যারিসকে সমর্থন’
পপ সুপারস্টার টেলর সুইফট তার ২৮৩ মিলিয়নেরও বেশি অনুগামীদের ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্টে বলেন – ‘আমি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমালা হ্যারিস এবং ওয়ালজকে আমার ভোট দেব।’ ট্রাম্পের নির্বাচনী পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে টেলর সুইফট বলেন, ‘আসল পরিকল্পনা সম্পর্কে আমাদের খুব স্বচ্ছ হওয়া দরকার’। পোস্টটির সাথে শিল্পী তার বিড়াল বেঞ্জামিনকে আগলে রাখার একটি ছবি দেন। অনেকে মনে করেন চাইল্ডলেস ক্যাট লেডি বিতর্কের জন্যই এই অর্থবহ ছবি দিয়েছেন জনপ্রিয় শিল্পী। উত্তরে ট্রাম্প শুধু একটি কথাই বলেছিলেন তিনি ‘টেলর ভক্ত নন’। সুইফটের পোস্টের কয়েকদিন পরে, জনমত জরিপে দেখা গেছে যে, হ্যারিস গুরুত্বপূর্ণ জনসমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হন। যার জেরে সাবেক প্রেসিডেন্ট তার ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন : ‘আমি টেলর সুইফটকে ঘৃণা করি!’
‘গলফ মাঠে ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা’
এবার আততায়ী গুলি ছোঁড়ার আগেই সিক্রেট সার্ভিসের নজরে পড়েন। ১৫ সেপ্টেম্বর ফ্লোরিডায় গলফ খেলার সময় ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করেন রায়ান রুথ নামের এক ব্যক্তি। পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায়, গাছের আড়াল থেকে ট্রাম্পের দিকে বন্দুক তাক করার সময়ই তাকে দেখে ফেলে সিক্রেট সার্ভিস এবং তাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এই আততায়ীকেও ঘটনাস্থলেই হত্যা করা হয়। এই হত্যাচেষ্টার জন্য বাইডেন ও হ্যারিসের ‘উস্কানিমূলক কথাবার্তাকে’ দায়ী করেন ট্রাম্প।
মঙ্গলবার ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থীরা ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করবেন। জরিপগুলি প্রমাণ করে যে, কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্ত প্রতিযোগিতা হতে চলেছে মার্কিন নির্বাচনে। এখন দেখার শেষ হাসি কে হাসে।
সূত্র : স্কাই নিউজ