সাইফুর রহমান শামীম, কুড়িগ্রাম।।: এই মসজিদে অবাধে নামাজ পড়ছে বাংলাদেশী ও ভারতীয়রা। দু’দেশের সীমান্ত চিহ্নিতকারী কাটাতারের বেড়ার একদিকে বাংলাদেশ এবং অপরদিকে ভারতীয় জনগোষ্ঠী থাকার কথা হলেও এখানে হয়েছে ব্যতিক্রম। এই এলাকায় কাটাতারের ভিতরে ভারতীয় গ্রাম ছোট গাড়লঝড়া। প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি পরিবারের বসবাস। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন অনুয়ায়ী ভারতীয় সরকার দেড়শ গজ সীমানার ভিতরে কাটাতারের বেড়া নির্মাণ করে। এ সময় এই গ্রামটি কাটাতারের বাইরে পড়ে যায়। স্থানীয় প্রশাসন এই পরিবারগুলোকে জমি দিয়ে কাটাতারের ভিতরে আনার জন্য বৈঠক করেও কোন সুরাহা হয়নি। পরিবারগুলোর দাবি আমরা যুগ যুগ ধরে এখানে বাপ-দাদার স্মৃতি নিয়ে বসবাস করছি। আমরা এই স্মৃতি ফেলে যেতে পারবো না। ফলে কাটাতারের ভিতরে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর সাথে ভারতীয় পরিবারগুলো সহাবস্থান করলেও বাংলাদেশীদের সাথে হয়নি কোন সমস্যা দেশভাগের পর থেকেই তারা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে নিজেদের দেশের কৃষ্টি কালচার মেনে পাশাপাশি বসবাস করে। আসছে।
জানা যায়, কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা দক্ষিণ বাঁশঝানি ঝাকুয়াটারী গ্রাম। এই গ্রামের সাথে অবস্থিত ভারতীয় গ্রাম ছোট গাড়লঝড়া। কেউবলে না দিলে মনে হবে এটিও বোধহয়
বাংলাদেশের কোন গ্রাম। কাটাতারের ভিতরে পাশাপাশি দুটি গ্রামের মানুষকে চিহ্নিত করে দিয়েছে একটি মসজিদ। এই মসজিদের দক্ষিণে বাংলদেশ এবং উত্তরে ভারত। মসজিদটি বাংলাদেশী আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার ৯৭৮ এর ৯-এস সীমানা ঘেঁষেই অবস্থিত।প্রায় দুশো বছর আগে বৃটিশ শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে স্থানীয় বয়োবিদ্ধরা জানান। মসজিদের উত্তর ঘেঁষে রয়েছে ভারতীয় গ্রাম ছোট গাড়লঝড়া। যা ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা থানার আওতাধীন।কাটাতারের ভিতরে এই গ্রামটি অবস্থান করলেও বাংলাদেশীদের সাথে সহাবস্থানে তাদের কোন সমস্যা হয় না। নিজ নিজ দেশের আইন-কানুন মেনে চলেন তারা। এতে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী গ্রামের লোকজনকে সবসময় সহযোগিতা করছে। সারাদেশে সীমান্ত জুড়ে যখন গুলি করে মানুষ খুন, পাচার, নির্যাতনের মতো নির্মম ঘটনা ঘটছে, সেখানে এই দুই গ্রামের মানুষ চরম সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতির উদাহরণ সৃষ্টি করে পাশাপাশি অবস্থান করছেন। ভারতীয় অধিবাসী আকবর আলী ও মোক্তার হোসেন জানান, সীমান্ত ভাগের পর থেকেই আমাদের পিতামহরা এখানে বসবাস করে গেছেন। আর বাঁশজানি মসজিদ ঘিরেই আমরা বেড়ে উঠেছি। এখানে আমাদের কোন নিরাপত্তার অভাব নেই। সকালে কাজের জন্য কাটাতারের বেড়া টপকিয়ে আমরা ভারতের অভ্যন্তরে চলে যাই। কাজ শেষে আবার ফিরে আসি। বাংলাদেশের মানুষ অনেক ভাল।আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। আরেক ভারতীয় নারী জুলেখা বেগম জানান, আমরা ভারত সরকারের দেয়া সকল সুয়োগ-সুবিধা পেয়ে আসছি। রাস্তা ঘাট ভাল হওয়ায় কাটাতারের ভেতর প্রায় ৩কি.মি. দূরে গিয়ে স্কুলে বাঁচ্চারা পড়াশুনা করছে। কাটাতারের এপারে থাকলেও নিরাপত্তা নিয়ে কখনও উদ্বিগ্ন হতে হয়না। কেননা বাংলাদেশের মানুষের সাথে মিলে মিশে থাকছি বহু বছর ধরে। এমনটি হয়ে গেছে কে ভারতের আর বাংলাদেশের মানুষ তা দেখে বোঝার উপায় নেই। বাংলাদেশী নাগরিক দক্ষিণ বাঁশঝানি ঝাকুয়াটারী গ্রামের কফিল উদ্দিন, মজদার আলী ও নুর ইসলাম জানান, ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ বাঁশজানি মসজিদ। দেশ স্বাধীনের পর দু’দেশের মানুষ এখানে মিলিতভাবে নামাজ আদায় করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা মসজিদে নামাজ পড়েই ভারতীয়রা নিজেদের সীমান্তে চলে যান। এছাড়া কেউ কারো সীমান্তে যান না। তারা আরও জানান, দু’দেশের নাগরিকদের অর্থে ১৫ শতক জমিতে আধাপাকা বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে বিল্ডিংয়ের অবস্থা নড়বড়ে। সীমান্ত এলাকায় হওয়ায় কোন সরকারই এই মসজিদেরউন্নয়নে এগিয়ে আসেনি। এছাড়াও বাংলাদেশী নাগরিক নুরী বেগম ও কল্পনাজানান, ভারতীয়রা কাটাতারের ভিতরে আমাদের সাথেবসবাস করেও সব রকমের সরকারি সুযোগ সুবিধাপাচ্ছে। কিন্তু আমরা কোন সরকারি সহায়তা পাই না। এখানে কোন রাস্তাঘাট নেই, নেই চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা। কাছাকাছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজিবি সদস্য জানালেন, এই সীমান্তে কখনও কোন নেতিবাচক ঘটনা ঘটেনি। এখানকার মানুষ চোরাচালান, মাদক ব্যবসার সাথে যুক্ত
নেই। কারও ইচ্ছা থাকলেও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তৎপরতায় কেউ সুযোগ পায়না। ভারতীয়রা বাংলাদেশী মসজিদে নামাজ পড়েই চলে যায়। এতে সুযোগ নিয়ে নেতিবাচক কিছু করে না। সে কারণে বিএসএফ কিংবা বিজিবি’র পক্ষ থেকে কোন বাধা দেয়া হয় না। ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউয়িন পরিষদ চেয়ারম্যান জানান, বাঁশজানি মসজিদটি ধারণা করা হয় প্রায় দু’শ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। এই একটি মসজিদে যাতায়াতের মাধ্যমে দু’ রাষ্ট্রের দুটি গ্রামের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ আজও অটুট আছে। দু’দেশের সীমান্তবাসীদের সম্প্রীতি দৃঢ় করতে ভারত-বাংলা সরকারের আলাদাভাবে নজর দেয়ার দরকার এই মসজিদের উন্নয়নে। মসজিদটি হতে পারে। দর্শনীয় স্থাপনা। এটি ইতিহাস সমৃদ্ধ।