বাংলাদেশের কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও অনেকের নিহতে সমব্যথী কলকাতার ছাত্রছাত্রীদের একাংশও। গত এক সপ্তাহে কলকাতায় শিক্ষার্থীদের অন্তত চারটি মিছিল বেরিয়েছিল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি চালানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও নানা কর্মসূচি হয়েছে বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার চারটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন কলকাতায় একটি মিছিলও করেছিল বাংলাদেশের ছাত্রদের প্রতি সংহতি জানিয়ে। মূলত বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো এ নিয়ে মুখ খুললেও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিবেশী দেশের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তবে বড় বামপন্থী পার্টিগুলো এবং অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে না দিয়েছে কোনো বিবৃতি, না করেছে কোনো মিছিল।
কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা বলছে, তাদের ক্ষোভের কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, বাংলাদেশের আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সাথে সময়মতো আলোচনায় কেন বসল না সরকার। দ্বিতীয়ত, যে পদ্ধতিতে আন্দোলন দমন করা হয়েছে, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছে, তা কখনই মেনে নেয়া যায় না। ক্যাম্পাসে পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রবেশ সবসময়ই কলকাতার ছাত্রছাত্রীদের কাছে অতি স্পর্শকাতর বিষয়। এর আগে, ২০১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ প্রবেশ করে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক মারধর করলে তার প্রতিবাদে ‘হোক কলরব’ নামের আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তা নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল।
‘রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আগ্রাসন’
অন্য দেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে কলকাতায় মিছিল-বিক্ষোভ নতুন নয়। চীনের তিয়েনানমেন স্কোয়ারে ১৯৮৯ সালে যে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছিল, তার বিরুদ্ধেও যেমন কলকাতায় মিছিল-বিক্ষোভ হয়েছিল, তেমনই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধেও ব্যাপক আন্দোলন করেছিলেন সেই সময়ের বামপন্থী ছাত্র-ছাত্রীরা। বাংলাদেশের ছাত্র-মৃত্যু এবং তাদের ওপরে সহিংসতার বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার যে চারটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন কলকাতায় মিছিল করেছে, সেগুলোরই অন্যতম অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)। সংগঠনটির রাজ্য সভাপতি ঋতম মাজি বলেন, ‘এ ধরনের মিছিলগুলো আমরা করছি, কারণ আমরা মনে করি যে কোনো দেশে, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর কোথাও যদি একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপরে এভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আগ্রাসন চালায়, আক্রমণ চালায়, একের পর এক ছাত্র-যুব শহিদ হচ্ছেন, সেখানে আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য তাদের প্রতি সংহতি জানানো এবং একটা কর্মসূচি নেয়া।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঠিক কী ভুল, সেটা নিয়ে আমরা এখান থেকে মন্তব্য করতে পারি না। ছাত্রদের এ নিয়ে দাবি তো সেই ২০১৮ সাল থেকে। কোনো দাবি উঠলে যে কোনো গণতান্ত্রিক, নির্বাচিত সরকারের তো এটাই যে প্রথম কাজ তা নিয়ে সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে সমাধান করা। তা না করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে ছাত্রদের আন্দোলনটাকে চুপ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলো।’ সিপিআইএম দলের ছাত্র সংগঠন এসএফআই কেন্দ্রীয়ভাবে আগেই একটি বিবৃতি জারি করে ‘বাংলাদেশের আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপরে ‘রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
সংগঠনটির কলকাতা জেলা সভানেত্রী বর্ণনা মুখার্জী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে ঠিক-ভুলের বিচার পরে হবে কিন্তু একটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপরে হস্তক্ষেপ কেন করা হলো? গণজমায়েত করে, নিজের মতপ্রকাশ করে কোনো বিষয়ে তার ভাবপ্রকাশ করা, এটার মধ্যে তো কোনো অন্যায় নেই! কণ্ঠস্বর রোধ যেভাবে করা হয়েছে সেখানে, এসএফআই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।’
‘ছাত্রছাত্রীরা ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটাতে পারে না’
কলকাতার সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের একাংশ এবং বেশ কিছু বামপন্থী রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সংহতি জানালেও আরএসএসের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) মনে করে ঘটনাগুলো অন্য দেশে হওয়ার কারণে এটা নিয়ে তাদের বলা শোভা পায় না, বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে হলে তা ভারত সরকার করবে। তবুও এবিভিপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অনিরুদ্ধ সরকার বলেন, ‘এদেশে বসে যা জানা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ছাত্র আন্দোলনে বহিরাগত প্রবেশ ঘটেছিল। তাদের সম্ভবত কেউ ভুল পথে চালিত করেছে। না হলে ছাত্রছাত্রীরা এরকম ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটাতে পারে না।’ বাংলাদেশের সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনার যেসব ভিডিও দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, তার অনেকগুলোই নজরে এসেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রূপকথা চক্রবর্তীর। বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে খবরা-খবরও রাখছেন তিনি।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, ‘বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা একটা দাবি জানাতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। ছাত্রসমাজ কিভাবে এটা মেনে নিতে পারি যে এই একই ঘটনা যদি আমাদের সাথে হয়, আমাদের কে রক্ষা করবে? দেশের ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করা তো সেখানকার সরকারের, বাহিনীগুলোর দায়িত্ব ছিল। সেখানে অধিকার আদায়ের আর্জি না শুনে সরাসরি যদি গুলি করা হয়, সেটা তো সরকারের ব্যর্থতা, পুরো সিস্টেমটার ব্যর্থতা।’
তার কথায়, ‘বাংলাদেশ তো আমাদের পাশের দেশ। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি দুই জায়গাতে। সেখানকার যেসব ভিডিও দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে, সেগুলো যতই বীভৎস হোক, সেসব দেখে যদি এখানকার ছাত্র সমাজ কিছু অনুভব করতে পারে, তারা যদি দুঃখ পায়, তবেই বোঝা যাবে যে আমরা এখনো মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলিনি।’
রাজনৈতিক দলগুলো চুপ কেন?
ছাত্র সংগঠনগুলোর একাংশ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে কিছু কর্মসূচি নিলেও রাজনৈতিক দলগুলোকে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে কোনো কর্মসূচি নিতে দেখা যায়নি। আবার কলকাতায় ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র বলে পরিচিত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় বা দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়েছে, এমন খবর নেই। শুধুমাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা পোস্টার দিয়ে, পথে নেমে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের সাথে সংহতি জানিয়েছে। কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক ও ‘দ্য ওয়াল’ সংবাদ পোর্টালের কার্যনির্বাহী সম্পাদক অমল সরকার বলেন, ‘মানবাধিকার বা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ঘটনায় কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা বরাবরই এগিয়ে আসে। সিপিআইএমের প্রবীণ নেতা বিমান বসু ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে ছিলেন ছাত্রনেতা। আমেরিকা-বিরোধী সেই আন্দোলন এতটাই ব্যাপক হয়েছিল যে বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা কলকাতায় নামতে পর্যন্ত পারেননি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এখানকার ছাত্রদের বড় ভূমিকা ছিল। তবে এবার দেখলাম কিছু ছাত্র সংগঠন ছাড়া আর কারো কোনো বক্তব্য নেই। কোনো দলই কিছু বলেনি। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি সমর্থনের প্রশ্নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অভিন্ন। তারা মনে করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ ভালো থাকবে। সেটা ভারতের জন্যও ইতিবাচক।’
সূত্র : বিবিসি