বগুড়ায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে শুক্রবার পর্যন্ত ১৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীর সাথে সাধারণ মানুষ, করাগারে আটক, অসুস্থ ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকদের গণহারে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে আসামির তালিকা নিয়ে বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, গত সপ্তাহে পুলিশের সাথে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং এর জের ধরে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর হয়। এতে প্রায় চার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে। এসব ঘটনায় শুক্রবার পর্যন্ত বগুড়া সদরে ১৩টি ও শেরপুর উপজেলায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, যুবদলসহ বিরোধী দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ১ হাজার ২০০ জনের বেশি নেতাকর্মী আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে সদরেই ১ হাজার ৮৯ জন। ইতোমধ্যে বগুড়া সদরে শতাধিকসহ প্রায় ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর হেনা, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সাইদুল ইসলাম, শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান বিদ্যুৎ প্রমুখ। এছাড়া শেরপুর উপজেলায় দায়ের করা নাশকতা মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৮ বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে এজাহার নামীয় মাত্র চারজন রয়েছেন।
জানা গেছে, নাশকতা মামলার আসামি আরিফুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। পায়ের হাড় এবং নার্ভ সমস্যাজনিত কারণে ঠিকমতো হাঁটা-চলা করতে পারেন না তিনি, ধীর পায়ে কোনোরকম চলা-ফেরা করেন। দিনের বেশিভাগ সময় তার ওষুধের দোকানে কাটান। রাজনীতির সাথে তার নূন্যতম সংযোগ নেই। চলমান আন্দোলনে বগুড়ায় ১৩ মামলার একটিতে তার নাম এসেছে ২৮ নম্বর আসামি হিসেবে। ওই মামলায় উল্লেখ আছে, দলবদ্ধভাবে সরকারি কাজে বাধা প্রদান, সরকারি কর্মচারিকে মারধর, বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে মৃত্য ঘটানো এবং জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন আসামিরা। আরিফুর রহমানকে বগুড়া পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের নায়েবে আমির উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তিনি জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সাথে কোনোভাবেই জড়িত নন।
অন্য রাজনৈতিক মামলায় হাজতি হিসেবে বর্তমানে বগুড়া কারাগারে বন্দী রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী বগুড়া শহর শাখার আমির আবিদুর রহমান সোহেল, সেক্রেটারি আবু সাইদ মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক, সাবেক ছাত্রশিবির নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদী। জেলখানার এসব হাজতিও মাঠে আন্দোলন করে নাশকতা করেছেন মর্মে মামলায় নাম উঠেছে। দলীয়ভাবে অভিযোগ করা হয়েছে, পুলিশ থানায় বসে পূর্বের মামলার নথি অনুযায়ী গণহারে নতুন মামলায় আসামি করছে। তারা জানেন না কারা কারাগারে আছেন বা বাইরে আছেন। বগুড়ার সিনিয়র সাংবাদিক সবুর শাহ লোটাস এক সময় আমার দেশ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। বর্তমানে তিনি স্থানীয় দৈনিক দূরন্ত সংবাদ-এর সম্পাদক এবং সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সিনিয়র সদস্য। এছাড়াও বগুড়ায় তার হাতে গড়া নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটিবি, তিনি সেটি চেয়ারম্যান। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুরে অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তার নাম রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট মামলার বিবরণের সাথে সম্পৃক্ত নই। সম্মানহানী এবং হয়রানি করার উদ্দেশ্যে মামলায় আমার নাম দেয়া হয়েছে।’ সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার আরেক সিনিয়র সদস্য আসাদুল হক কাজলের নামও দেয়া হয়েছে ওই মামলায়। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং বগুড়া বিআরটিসি শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এবং বগুড়া পৌর আওয়ামী লীগের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সদস্য। ইতোপূর্বে তিনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা ছিলেন। তার নাম আসামির তালিকায় দেখে আওয়ামী লীগ নেতারাও স্তম্বিত ও হতবাক। কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সপ্তাহখানেক আগে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাকি তাজওয়ার। সেই জাকি তাজওয়ারকে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় আসামি করা হয়েছে। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক খালেকুজ্জামান রাজা মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) বিস্ফোরক আইনে এ মামলা করেন। এ মামলার এজাহারে ১২ নম্বর আসামি করা হয়েছে জাকি তাজওয়ারকে। বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি এলাকার রুপু হাসান। তিনিও কখনো রাজনীতির ধারে কাছে যাননি বলে জানা গেছে। বগুড়া জেলা মোটর মালিক গ্রুপের অধীনে বগুড়া-দূর্গাপুর সড়কের ‘চেইন মাস্টার’ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত দায়ের করা একটি মামলায় তাকেও ৩৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নাশকতা, সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা-সংক্রান্ত নয়টি মামলার বাদি পুলিশ। এছাড়া আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ, এসি ল্যান্ড অফিস ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ, পোস্ট অফিসে ভাঙচুর ও রেলওয়েতে নাশকতার ঘটনায় বাকি চারটি মামলা স্ব স্ব দফতর থেকে করা হয়েছে। বগুড়া কারাগারে বন্দী অবস্থায় কোটাবিরোধী আন্দোলনে কিভাবে যোগ দিয়ে নাশকতা করলেন জামায়াতের তিন নেতা- এমন প্রশ্নের জবাবে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার জাকির হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বন্দী থাকা অবস্থায় নতুন মামলায় নাম আসার কথা নয়। এটা কিভাবে হলো আমি দেখব।’ তিনি আরো জানান, এজাহার নামীয়রা বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত।