নওগাঁ প্রতিনিধি : ছোট বেলায় আমরা একটা কবিতা পড়তাম-ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গাঁ, ঐখানেতে বাস করে কানাবগীর ছায়- তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে- বইয়ের পাতায় কবিতা থাকলেও বাস্তবে আজ কোন মিল নেই। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী তাল গাছ। বর্তমান সরকার তাল গাছ রোপণের উপর জোর দিলেও এক শ্রেণির মানুষ কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছে। নানা কারণ দেখিয়ে রাস্তার পাশের ও ব্যক্তি মালিকানাধীন তাল গাছ কেটে বিভিন্ন করাতকলে বিক্রি করছে। এ কারণে ঝড়, বৃষ্টি ও বিজলী (বিদ্যুৎস্পৃষ্টের) হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ, পশু-পাখি সহ জীব বৈচিত্র্য। যখন এমন পরিস্থিতি সবখানে তখন উত্তরের জেলা নওগাঁ দেখা মিলেছে এক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। জাতীয় একটি দৈনিক সকালে সময় পত্রিকার সংবাদকর্মী ও সমাজকর্মী মাহমুদুন নবী বেলাল নিজ উদ্যোগে বিগত ৭ বছরে নওগাঁ ও রাজশাহী জেলায় তিন লাগ তালগাছ রোপণ করেছেন। তালগাছকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতেই তার এই মহতী উদ্যোগ। ৮০ কিলোমিটার সড়কে বর্তমানে শোভা পাচ্ছে বেলালের রোপণ করা তালগাছ। এ ছাড়া আর প্রায় ৩০ হাজার ফলদ ও ঔষধি গাছও লাগিয়েছেন বেলাল। প্রতিদিন নওগাঁ জেলার বিভিন্ন সড়ক ও নওগাঁ রাজশাহী সড়কে তিনি তালগাছ পরিচর্যা ও তালের বীজ লাগানোসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ রোপণ ও পরিচর্চা করে চলেছেন। তার এমন উদ্যোগে ইতিমধ্যে সকলের কাছে সাড়া ফেলেছে। মাহমুদুন নবী বেলালের বাড়ি জেলার মান্দা উপজেলার বৈলশিং পানাতাপা গ্রামে।
কথা হলে বেলাল বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গত ৭ বছর ধরে জেলার বিভিন্ন স্থানে ও রাস্তার পাশে তালবীজ রোপণ করেছি। পাশাপাশি নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের নওহাটা মোড় থেকে রানীরপুকুর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী ৩০ হাজার গাছের চারা রোপণ করেছি। এ ছাড়া নওগাঁ আদালত চত্বর, টিটিসি চত্বর, সরকারী কলেজ চত্বর, এলইজিডি চত্বর সহ নওগাঁ পৌরসভার রাস্তার দু পাশেও সোভা বর্ধন গাছও সামনেও বিভিন্ন প্রকার গাছের চারা রোপণ করে নিজেই নিয়মিত পরিচর্যা করছি। গত ৭বছর নওগাঁ ও রাজশাহীর সড়কে দুপাশে প্রায় ৩ লাখ করে তালবীজ রোপণ করেছি। এ কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তালবীজ রোপণে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসলে এমন উদ্যোগ আগামী চালিয়ে যেতে পারবো।
তার এমন উদ্যোগে তালের আঁটি রোপণে বেলালকে সার্বক্ষণিক মানসিকভাবে সাহস দিয়েছেন তার বাবা স্বাস্থ্য বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইব্রাহিম হোসেন। এক যুগ আগে গহের আলী তালগাছ রোপণ করে পেয়েছিলেন জাতীয় পরিবেশ পদক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে ২০০৯ সালে পদক তুলে দিয়েছিলেন। এর পরের বছর মারা যান গহের আলী। সেই ফলবতী তালগাছগুলো এখন আর নেই। সড়ক প্রশস্ত করতে গিয়ে সব তালগাছ কাটা পড়েছে। তবে গহের আলীর ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মাহমুদুন নবী বেলাল। নতুন করে রোপণ করেছেন তালের আঁটি। একদিন গহের আলীর সেই স্থানে তালগাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে বিশ্বাস তার।
বেলাল বলেন, ‘আমার ইচ্ছা এই বর্ষায় নওগাঁ সদর উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০-১৫টি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিনা মূল্যে রোপণের জন্য বিতরণ করব। এ লক্ষ্যে প্রায় ৩০ হাজার গাছের চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে। সরকারিভাবে বেশি বেশি গাছের চারা বিতরণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবিও জানান এই বৃক্ষপ্রেমী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাহমুদুন নবী বেলাল সত্যিই সুন্দর একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। যত বেশি গাছ লাগানো হবে তত বেশি প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকবে। দেশের প্রায় সর্বত্রই তাল গাছসহ বড় বড় গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এতে করে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানি বাড়ছে। তার এমন মহতি উদ্যোগ সকলের জন্য অনুকরণীয় হবে বলে বিশ্বাস করি।
জেলা বন অফিস নওগাঁর সহকারী বন সংরক্ষক মোঃ মেহেদীজ্জামান বলেন, যেভাবে তাল গাছ কাটা হচ্ছে, সেভাবে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন ও জনবসতি বাড়ায় গ্রামাঞ্চলে বড়বড় গাছপালাসহ জঙ্গল কেটে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে তাল গাছসহ অনেক জাতের গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মাহমুদুন নবী বেলালের এমন উদ্যোগ প্রসংশার দাবি রাখে। তার কোন সহায়তার প্রয়োজন হলে আমরা তার পাশে থাকবো।