শাহীন রহমান, পাবনা : পলো, খেয়া জাল, বাদাই জাল সহ নানারকম সরঞ্জাম নিয়ে মাছ শিকারে হাজারো সৌখিন মানুষের ঢল। দল বেঁধে মাছ শিকারের এই আয়োজনের নাম ‘বাউত উৎসব’। গ্রামীণ ঐতিহ্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বছরের পর বছর এই সময়ে পাবনার চলনবিলে চলে আসছে এই উৎসব। তবে দিন দিন বিল-জলাশয়ের আয়তন কমে যাওয়ায় মিলছে না, আগের মতো দেশীয় প্রজাতির মাছ। প্রভাবশলীদের দৌরাত্মে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে গ্রামীণ এই উৎসব। শনিবার সকাল সাতটায় পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার রুহুল বিলে গিয়ে দেখা যায়, প্রচন্ড শীতকে উপেক্ষা করে কাক ডাকা ভোরে মোটরসাইকেল, বাস, সিএনজি চালিত থ্রি হুইলার, অটোরিকশা, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে বিল অভিমুখে ছুটছে মানুষ। সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিলপাড়ে হাজির তারা। এরপর নিজেদের প্রস্তত করে একসাথে বিল অভিমুখে যাত্রা। কারো হাতে পলো, আবার কারো হাতে ঠেলা জাল, বাদাই জাল সহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। এভাবেই চলনবিলে উপস্থিত বিভিন্ন জেলার হাজারো শৌখিন মৎস্য শিকারি। লোকজ রীতিতে বিলের জলে মনের আনন্দে চলছে মাছ শিকার। সূচনার ইতিহাস অজানা হলেও, চলনবিলাঞ্চলে এমন উৎসব চলছে বছরের পর বছর। দলবেঁধে মাছ ধরার এ আয়োজনে মৎসশিকারীদের ডাকা হয় বাউত। তাদের ঘিরেই উৎসবের নামকরণ। চলনবিলের রুহুল বিল, ডিকশির বিল, রামের বিল সহ বিভিন্ন বিলে মাসব্যাপী চলে এই বাউত উৎসব।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নভেম্বরের শেষে অথবা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয় মাসব্যাপী এই উৎসব। সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ভোর থেকে বিলাঞ্চলের পূর্বনির্ধারিত এলাকায় দল বেঁধে মাছ শিকারে নামেন বাউতেরা। বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরী হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। কারো ভাগ্যে মেলে শোল, বোয়াল, রুই, কাতল, গজার, টাকি সহ বিভিন্ন দেশী মাছ। আবার কেউ ফেরেন খালি হাতে। তবে আনন্দটাই তাদের কাছে মুখ্য।
টাঙ্গাইলের মধুপুর থেকে বাউত উৎসবে এসেছেন ষাটোর্ধ ছকির উদ্দিন। জানালেন, অনেক নাম শুনেছি এই বাউত উৎসবের। কখনও আসা হয়নি। এবার এসে যা দেখলাম তাতে মুগ্ধ হয়ে গেছি। এত বড় উৎসব আর হাজার হাজার মানুষ একসাথে বিলে মাছ ধরার আনন্দটাই অন্যরকম।
নাটোরের গুরুদাসপুরের আনিছুর রহমান, সিরাজগঞ্জের তাড়াশের আকবর হোসেন সহ অন্যরা জানান, প্রতিবছর বাউতে নেমে একসাথে মাছ ধরার অনুভূতি ভাললাগার। কেউ মাছ পাই বা না পাই তাতে কারো মন খারাপ হয় না। আনন্দটাই আমাদের কাছে আসল।
তবে, সৌখিন মৎস শিকারীদের অভিযোগ, একদিকে কমে আসছে বিল, জলাশয়। অন্যদিকে, প্রভাবশালীদের দৌরাত্মে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে গ্রামীণ এই উৎসব। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন সে দলের প্রভাবশালী নেতারা ভোগদখলে থাকে। চায়না জালে ধ্বংস করা হয় মাছের প্রজনন। বিলপাড়েই দেখা গেলো বেশকিছু নিষিদ্ধ চায়না জাল। যেকারণে আগের মতো দেশী মাছ পাওয়া যায়না বলে দাবি তাদের।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ হাসান খান বলেন, গ্রামীণ এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বিল জলাশয়ে দেশী মাছে অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে। আরো অনেক পরিকল্পনা সামনে রয়েছে। সেইসাথে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম বন্ধ আর নিষিদ্ধ চায়না জালের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর আশ্বাস দেন তিনি।