উত্তরকোণ ডেস্ক: গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ও গোয়াল ভরা গরু ছিল রংপুরের গঙ্গাচড়ার পশ্চিম ইচলী গ্রামের ফজলুল হক ও আছিয়া বেগমের। সংসারে অভাব বলতে কিছু ছিল না তাদের। ভারত থেকে আসা পানির ঢলে ভেসে গেছে সবকিছু। এক দিনেই সবকিছু হারিয়েছেন তারা। এখন ঠাঁই হয়েছে নদীর বাঁধে। কার্তিকের প্রবল বৃষ্টির মধ্যে পলিথিন মুড়ি দিয়ে রাত কাটিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তাদের মতোই দুরবস্থায় পড়েছে রংপুর ও লালমনিরহাটের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। তিস্তা নদীর বামতীরে বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় পানি কয়েকটি চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলী গ্রামে ঢুকে লন্ডভন্ড করেছে সবকিছু। ফজলুল হক বলেন, এক একর জমিতে ধান ছিল। আর ১৫ দিন পর ধান কাটতেন তিনি। নদীর পানি আকস্মিক বাড়ায় বুধবার বিকেলে ঘরবাড়ি ডুবে যায়। নদীতে ভেসে গেছে তার ৮টি গরু ও জমির ধান। সন্ধ্যায় বাঁধের ওপরে পরিবারসহ কোনোমতে জীবন নিয়ে আসতে পেরেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ভারি বর্ষণের কারণে গজলডোবার সব গেট খুলে দেওয়া হয়। এতে মঙ্গলবার রাতে তিস্তার পানি হুহু করে বাড়তে থাকে। বুধবার সকালে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘন্টা, মর্নেয়া ইউনিয়নসহ কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার চর, দ্বীপচর ও তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। পানির তীব্র স্রোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জরুরি অবস্থা মোকাবিলাসহ জানমাল রক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাইকিং করে সবাইকে নিরাপদ স্থানে অবস্থানের জন্য আহ্বান জানায়। বুধবার রাতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নে উদ্ধার তৎপরতা চালায় সেনাবাহিনী। স্পিডবোটের মাধ্যমে চরগুলো থেকে পানিবন্দিদের নিরাপদ স্থানে উদ্ধার করে আনা হয়। এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
রেকর্ড পানি: বুধবার তিস্তা নদীতে সর্বোচ্চ পরিমাণ পানি রেকর্ড করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ২০১৭ সালে তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে সর্বোচ্চ পানি রেকর্ড করা হয় ৫৩ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। বুধবার তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৫৩ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। যা তিস্তা নদীর পানির উচ্চতায় রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে বলে জানায় পাউবো। বর্তমানে পানি অনেক কমে গেছে।
লন্ডভন্ড তিস্তা তীরবর্তী গ্রাম: আকস্মিক বন্যায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে লালমনিরহাটের নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো। জেলার ৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় সেগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বানের পানিতে ভেঙে গেছে শ্রেণিকক্ষ। বাঁধ ও ৯টি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে বানভাসি মানুষ গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলার চারটি উপজেলার প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বন্যায় তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে থাকা জেলার চারটি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। রাস্তাঘাট ভেঙে তলিয়ে যায় বসতভিটা। তলিয়ে যায় আগাম আলু আবাদ ও উঠতি আমন ধানের ক্ষেত। বানভাসি মানুষ তাদের গবাদি পশু নিয়ে উঁচু স্থান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়তে থাকায় বুধবার দুপুর ১২ টার দিকে ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাসের ৬১০ মিটারের মধ্যে ৩০০ মিটার এলাকা ভেঙে যায়। ব্যারাজ এলাকায় জারি করা হয় রেড অ্যালার্ট। মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। ভারত থেকে ধেয়ে আসা পানি নিয়ন্ত্রণে হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করে। দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় তিস্তা। পানি নামতে শুরু করলে বেরিয়ে আসে ক্ষতচিহ্ন। কাকিনা মহিপুর সেতু হয়ে রংপুরে যাওয়ার সড়কটি পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। এতে যান চলাচল বন্ধ হলে বিপাকে পড়ে মানুষ। সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের কালমাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া বানভাসি ফেছকো মামুদ জানান, গত ৩০ বছরে এমন বন্যা তিনি দেখেননি। লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, জেলায় ১৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এসব মানুষের খাদ্য সহায়তার জন্য ১৭০ টন জিআর চাল ও নগদ ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ২০০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বলে তিনি জানান।