অনলাইন ডেস্ক: জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে এক দশক আগে দেশে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর বিশেষ আইনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়াতে আজ বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সংসদে বিল পাস হয়েছে। তবে বিলটি পাসের বিরোধিতা করেছেন বিএনপি ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল-২০২১’ সংসদে পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনীর প্রস্তাবগুলো করা নিষ্পত্তি হয়। গতকাল (বুধবার) বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন।
বিলটি পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিরোধী সদস্যরা বিরোধিতা করেন। তবে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতেই এই বিলটি আনা হয়েছে।
২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিদ্যুৎ সংকট দ্রুত সমাধানের লক্ষে বেশ কয়েকটি ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর এটা করার জন্য ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’।
শুরুতে দুই বছরের জন্য এই আইন করা হলেও পরে কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়। এবার পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন মিললো সংসদে।
২০১০ সালে প্রণীত আইনটির মেয়াদ সর্বশেষ তিন বছর বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২১ সাল পর্যন্ত করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় অতিদ্রুত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় তিন বছর, পাঁচ বছর ও ১৬ বছর মেয়াদী ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল) বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন শুরু করে। এসব ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বৈধতা দিতে নতুন আইনটি করা হয়।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ২০২৪ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে গত মার্চে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল।
বিলটি সংশোধনের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস হতে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার লক্ষে এখাতে দ্রুত অধিক সংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।
মন্ত্রী আরও বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন; ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য।
বিলটি পাসের জন্য তোলার পর এর বিরোধিতা করেন জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা। তারা বলেন, জনগণের করের টাকা অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এই আইন করা হচ্ছে। অসৎ উদ্দেশ্যে বিলটি তড়িঘড়ি করে পাস করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন আইনটি ‘জঘন্য কালো আইন’।
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, আরও পাঁচ বছর কেন বাড়ানো হচ্ছে। আমরা শতভাগ বিদ্যুতের কথা বলছি। রূপপুর, মাতারবাড়িতে বড় প্রকল্প করছি। ঋণের বোঝা বাড়ছে। এভাবে চললে দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে। এই আইন করে আমরা অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা দিচ্ছি। বিশেষ বিধান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমনসহ বিভিন্ন সময় করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষ বিধান কেন ১৬ বছর ধরে চলবে। বিশেষ বিধান সাময়িক সময়ের জন্য করলেন। আজকে কেন আবার পাঁচ বছর? সর্বোচ্চ এই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করেন। এ ছাড়া ঘোর আপত্তি থাকবে। বিশেষ বিধান এভাবে বছরের পর বছর চলতে পারে না।
গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, এই আইন একটি জঘন্য কালো আইন। এখানে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে করা হচ্ছে। জনগণের টাকা অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এই আইন করা হয়েছে।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু নিজের এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এলাকায় বিদ্যুৎ পাই না। চৈত্র, বৈশাখ, ভাদ্র মাসে মানুষ ঘুমাতে পারে না। এলাকায় ৪-৫ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। জোরে বৃষ্টি হলে বিদ্যুৎ যায়। বাতাস হলে বিদ্যুৎ যায়। আমাদের বাঁচান। আইনের এক্সটেনশন দরকার নেই। বিদ্যুৎ দেন।
চুন্নু বলেন, আপনারা বলছেন ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। অর্ধেক ব্যবহার হয়। সঞ্চালন লাইন নেই। পায়রার কয়লাভিত্তিক কিনতে পারছেন না। সঞ্চালন লাইন নেই বলে। ওইগুলো কেনেন। প্রকল্প বসে আছে। ক্যাপাসিটি চার্জ কত দিয়েছেন? করতেছেন, করেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। আরও কিছু লোকের জন্য এই আইনের দরকার নেই। সঞ্চালন লাইন করেন।’
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এলাকায় বিদ্যুৎ আসে না যায় বোঝা যায় না। আমাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। আপনি অল্প জনবল দিয়ে সেবা দিচ্ছেন। একটা লাইন দিয়ে ৬০-৭০ কিলোমিটার লাইন চালাচ্ছেন। আমরা শতভাগ বিদ্যুৎ চাই না। আগের অবস্থায় ফিরতে চাই।
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। এই আইনে কিছু মানুষের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জনগণের টাকা কিছু মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়া হবে কিন্তু তা নিয়ে কথা বলা যাবে না। বড় বড় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পরিকল্পিতভাবে অচল করা করে রাখা হচ্ছে।
পীর ফজলুর রহমান বলেন, কুইক রেন্টাল ব্যয়বহুল। কেন এটা করা হচ্ছে। সঞ্চালন লাইনে কেন নজর দেওয়া হচ্ছে না।
জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিলটি নতুন করে আনা হয়নি। সময় বাড়ানো হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ যাতে দিতে পারি সেজন্য এই আইন। ছয় মাসের মধ্যে যাতে কাজ করতে করতে পারি সেজন্য এই আইন। শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছি। এখন নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চাই। সঞ্চালন লাইন করতে গেলে সময় লাগবে। এটা কুইক রেন্টালের জন্য না। দ্রুত সরবরাহের জন্য এই আইন। আমাদের দ্রুত সঞ্চালন করতে হবে। মাটির নিচে যেতে হবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ঢাকা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে। সিলেট যাবে, খুলনা যাবে।